দুধ এর রকমফের, জানা আছে কি?

শিশুর জন্মের পর তার প্রথম ও একমাত্র খাবার দুধ (milk)। এতো খাবার থাকতে একজন নবজাতকের জন্য প্রকৃতি দুধকে কেনো বেছে নিয়েছে বলতে পারেন কি? শুধু তাই নয় বয়োঃবৃদ্ধ পর্যন্ত সকল বয়সীদের খাদ্য তালিকাতেই স্থান করে নেয় এই খাবারটি। এর অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে একে আদর্শ খাবার হিসেবে অভিহিত করা হয়। আদতে আদর্শ খাবার বলতে এমন খাবারকে বোঝায় যাতে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, মিনারেল ও পানি – খাদ্যের এই ছয়টি পুষ্টি উপাদান উপস্থিত থাকে। দুধে এই উপাদানগুলো বেশ ভালো পরিমাণে উপস্থিত থাকায় নবজাতক থেকে শুরু করে বয়োঃবৃদ্ধ সকলের খাদ্য তালিকায় এটি স্থান পায় নিমিষেই।

এই দুধেরও আবার রয়েছে নানান ধরণ। অনেকেই হয়তো ভাবছেন দুধ তো দুধই, এর আবার কিসের রকমফের। আদতে বেশ কিছু বিষয়ের উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয় দুধের ধরণ। এই যেমন প্রাপ্তি, প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি সহ আরও অনেক কিছুই রয়েছে এই তালিকায়। আজ জানবো সেসব নিয়েই।

দুধ (Milk) প্রদানকারী পশুর ভিত্তিতে

অঞ্চল ভিত্তিতে দুধ প্রদানকারী পশুও ভিন্ন হয়। আমাদের দেশে সাধারণত গরু, ছাগল মহিষ ও ভেড়ার দুধ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। তবে এগুলোর মধ্যে গরু ও ছাগলের দুধই অধিক গৃহীত। সমপরিমান গরুর ও ছাগলের দুধ থেকে প্রাপ্ত কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন বা ফ্যাটে কোন তারতম্য না থাকলেও ক্যালরির দিক থেকে গরুর দুধ এগিয়ে। তাছাড়া কিছু অনুপুষ্টিতেও এই পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এই যেমন এক কাপ গরুর দুধে ২৭৬ মি,গ্রা ক্যালসিয়াম থাকে কিন্তু সমপরিমাণ ছাগলের দুধ থেকে পাওয়া যায় প্রায় ৩২৭ মি,গ্রা। আবার একইভাবে ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস ও পটাসিয়ামের দিক থেকেও এগিয়ে থাকে ছাগলের দুধ। আবার ছাগলের দুধে গরুর দুধ অপেক্ষা ল্যাকটোজ ১ শতাংশ কম থাকে।

পাস্তুরায়নের ভিত্তিতে 

পাস্তুরায়ন বা পাস্তুরাইজেশন মূলত তাপপ্রয়োগের মাধ্যমে নির্বীজকরণ পদ্ধতি যা বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের নামে অভিহিত। এই পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট সময় ধরে দুধকে নির্বীজ বা দুধের জীবানু নাশ করা হয়। এই পদ্ধতিতে এই পাস্তুরায়ন সম্পন্ন হয়ে থাকে। যেমন –

এইচটিএসটি (HTST) বা High-Temperature Short Time method: 

এই পদ্ধতিতে ৭১.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কাঁচা দুধকে  ১৫ সেকেন্ডের জন্য রাখা হয়। এর ফলে তাপরোধী প্যাথোজেনকে নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব হয়। অনেক ক্ষেত্রেই এই তাপমাত্রা বজায় রাখা সম্ভব না হওয়ায় ৭২ থেকে ৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ২০ সেকেন্ডের জন্য রাখা হয়। এই পদ্ধতিতে পাস্তুরায়িত দুধ (milk) সাধারণত ১৬ থেকে ২১ দিন পর্যন্ত ঠিক থাকে।

এলটিএলটি (LTLT) বা Low-Temperature Long Time method:

এই পদ্ধতিতে দুধের তাপমাত্রা কমিয়ে ৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে এনে ৩০ মিনিট সময়ের জন্য রাখা হয়। সাধারণত এই পদ্ধতিতে পাস্তুরায়িত দুধ দই বানানোর জন্য উত্তম।

ইউএইচটি (UHT) বা Ultra-High Temperature method:

এই পদ্ধতিতে দুধের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে ১৩৫ থেকে ১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে ২ সেকেন্ডের জন্য রাখা হয়। এই পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ আবদ্ধ পদ্ধতিতে করা হয়। পাস্তুরাইজ করার পর সম্পূর্ণ বায়ুরোধী প্যাকেটে সংরক্ষণ করা হয়। দুধের মান বিবেচনায় এটি পুরো বিশ্বে সর্বাধিক জনপ্রিয় পদ্ধতি।

দুধে ফ্যাট বা চর্বির উপস্থিতির ভিত্তিতে 

দুধের একটি অন্যতম উপাদান হচ্ছে ফ্যাট। এই ফ্যাটের উপস্থিতি বিবেচনায় দুধকে আবার কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়।

হোল (whole) মিল্ক বা পূর্ণ ননীযুক্ত দুধ

দুধের অন্যতম উপাদান ফ্যাট বা ননী। দুধে যদি ফ্যাটের পরিমাণ অন্তত ৩.৫ শতাংশ থাকে তবে তাকে পূর্ণ ননী যুক্ত দুধ বলা হয়ে থাকে।

লো ফ্যাট মিল্ক

এই ধরনের দুধে ফ্যাট বা ননীর পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে ফেলা হয়। সাধারণত প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় দুধের ১ থেকে ১.৫ শতাংশ ফ্যাট অপসারিত করা করা হয়। এই ধরণের দুধ উচ্চ কোলেস্টেরল রোগীর জন্য সহায়ক।

স্কিম মিল্ক

এই ধরণের দুধে ফ্যাট বা ননীর পরিমাণ কমিয়ে ০.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। যেহেতু ফ্যাটের পরিমাণ কমিয়ে ফেলা হয় তাই এই দুধের ক্যালরিও অনেকাংশেই কমে যায়। যারা ওজন কমাতে চান তারা এই দুধ সেবন করতে পারেন।

সাধারণত ফ্যাট ও ক্যালরি ব্যতীত এই তিন ধরনের দুধের মধ্যে আর কোন পুষ্টি উপাদানের তেমন তফাৎ লক্ষ্য করা যায় না।

অন্যান্য 

ফ্লেভারযুক্ত দুধ (Milk)

আজকাল বাজারে বিভিন্ন ধরনের ফ্লেভারযুক্ত দুধের দেখা মিলে। এই যেমন চকোলেট, স্ট্রবেরি, ম্যাংগো ইত্যাদি। এইসব দুধে প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় আকাঙ্ক্ষিত ফ্লেভার আলাদা করে যুক্ত করা হয়। এর ফলে দুধের পুষ্টিমান বজায় থাকলেও স্বাদে আসে পরিবর্তন। সাধারণত বাচ্চারা এই ধরনের দুধ বেশ পছন্দ করে থাকে।

আমন্ড মিল্ক বা কাঠবাদামের দুধ

আমন্ড বা কাঠবাদামের দুধ মূলত প্ল্যান্ট বা উদ্ভিজ্জ দুধ বলা যায়। সাধারণত কাঠবাদাম থেকে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এই দুধে বিদ্যমান প্রোটিন, ফ্যাট সহ অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের সাথে গরুর খাঁটি দুধের বেশ তফাৎ লক্ষ্যনীয়। যাদের ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স সমস্যা আছে বা যারা কোন কারণে প্রানিজ খাদ্য এড়িয়ে চলেন তাদের ক্ষেত্রে এই দুধ বেশ কার্যকরী।

নারিকেল দুধ

বিভিন্ন রান্নায় ব্যবহৃত হয় বিধায় নারিকেল দুধ খানিকটা পরিচিতই বলা যায়। নারিকেল দুধের সাথে সাধারণ গরুর দুধের অনেক পার্থক্য। কোরানো নারিকেল থেকে এই দুধ নিষ্কাশন করা হয়। এর স্বাদও গরুর দুধ অপেক্ষা ভিন্ন হয়।

সয়া দুধ (Milk)

সয় বা সয়া দুধও সাধারণ গরুর দুধ অপেক্ষা ভিন্ন। এটি এক ধরণের উদ্ভিদজাত পানীয়। সয়া বীজ  ভিজিয়ে রেখে, পিষে তারপর সিদ্ধ করে সেখান থেকে ছেঁকে নিয়ে এক ধরণে দুগ্ধসদৃশ পানীয় নিষ্কাশন করা হয় যা সয়া দুধ হিসেবে খ্যাত। দুধের বিকল্প হিসেবে অনেকে গ্রহণ করে থাকলেও এর পুষ্টিমানে রয়েছে বিস্তর ফারাক।

কালের বিবর্তনে ও চাহিদার ভিত্তিতে বর্তমানে বাজারে অনেক ধরণের দুধের দেখা মিললেও সার্বিক বিবেচনায় খাঁটি দুধই সেরা। খাঁটি দুধ থেকে পর্যাপ্ত পুষ্টির যোগান নিশ্চিত হয় যার অনেকটাই হারিয়ে যায় প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রক্রিয়ায়। তাই প্রকৃতির দারস্থ হওয়াই সুস্থতার জন্য আবশ্যক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Home
Shop
Cart
Search